নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতার মূলভাব হলো স্বপ্নের উচ্ছ্বাসে ভরা একটি সুন্দর নির্ঝর প্রদেশে বাসবাস করা কল্পিত দৃশ্যের আবারও মূর্ত বিভিন্ন অঙ্গনের উপর গড়ে উঠা। কবি নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গে একটি রূপকথার মাধ্যমে পাঠানোর চেষ্টা করেন, যার মাধ্যমে স্বপ্নের প্রকৃতির পরিবর্তন, সংকুচিত হওয়া, ভেঙ্গে যাওয়া, পুরানো সৃষ্টিকে নতুন আকৃতি প্রদান করা ইত্যাদির ব্যাখ্যা করা হয়।
এই কবিতায় নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গে ব্যক্ত হলো স্বপ্নের ক্ষণিকতা ও অস্থায়ীত্ব, যা মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভঙ্গ উত্পাদন করে। নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গে মানুষের চিন্তা, কল্পনা ও স্বপ্নের প্রকৃতির সমন্বয়ের মাধ্যমে জীবনের অস্থায়ীত্ব, বিচিত্রতা, কল্পনার ক্ষণিকতা ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চিত্রিত হলেও, সেই ক্ষণিকতার উপর আস্থা বজায় রাখা যায় না। তার মাঝে নিজের মধ্যে অন্য অন্য ক্ষণিকতার পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ পরিবর্তিত হয়, স্বপ্নের দৃশ্য গঠনের মাধ্যমে সৃষ্টি ও ধ্বংসের প্রক্রিয়া প্রতীত হয়। নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতা মাধ্যমে ব্যক্ত হলো এই জীবনের ভঙ্গ, স্বপ্নের অস্থায়ীত্ব, চিন্তার নানান আকৃতির উপর সৃষ্ট ছবি ও তার নিঃশব্দ মৌলিকতা।
“নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” কবিতা লেখেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এটি তিনি রচনা করেন বঙ্গবন্ধু গ্রন্থ ‘গীতাঞ্জলি’র অন্তর্ভুক্ত কবিতার মধ্যে। এই কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বপ্ন, ভঙ্গ, কল্পনা এবং মনের আনন্দের মধ্যে কল্পিত দৃশ্য সৃষ্টির মাধ্যমে নির্মিত হয়েছে। এই কবিতাতে প্রকৃতির সুন্দর নির্ঝর এবং মানুষের স্বপ্নের বিচিত্র ভঙ্গ চিত্রণ করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় অস্থায়ীত্ব, ক্ষণিকতা, ব্যক্তির চিন্তা ও স্বপ্নের মধ্যে পরিবর্তনের উপর ভাবনা করা হয়েছে। তিনি এই কবিতার মাধ্যমে মানুষের চিন্তার ভেতর একটি অপরিবর্তনশীল দিন-ব্যাপী প্রকৃতির পরিবর্তনশীলতা ব্যক্ত করেন।
নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতা এর উৎসঃ
ভারতী পত্রিকায় ১২৮৯ খ্রিষ্টাব্দের অগ্রাহায়ন মাসের সংখ্যায় নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়।
নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতাঃ
আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর, কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান! না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ। জাগিয়া উঠেছে প্রাণ, ওরে উথলি উঠেছে বারি, ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি। থর থর করি কাঁপিছে ভূধর, শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে, ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল গরজি উঠিছে দারুণ রোষে। হেথায় হোথায় পাগলের প্রায় ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায় – বাহিরেতে চায়, দেখিতে না পায় কোথায় কারার দ্বার। কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন, চারি দিকে তার বাঁধন কেন! ভাঙ্ রে হৃদয়, ভাঙ্ রে বাঁধন, সাধ্ রে আজিকে প্রাণের সাধন, লহরীর পরে লহরী তুলিয়া আঘাতের পরে আঘাত কর্। মাতিয়া যখন উঠেছে পরান কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ! উথলি যখন উঠেছে বাসনা জগতে তখন কিসের ডর! আমি ঢালিব করুণাধারা, আমি ভাঙিব পাষাণকারা, আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া আকুল পাগল-পারা। কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া, রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া, রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া দিব রে পরান ঢালি। শিখর হইতে শিখরে ছুটিব, ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব, হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি। এত কথা আছে, এত গান আছে, এত প্রাণ আছে মোর, এত সুখ আছে, এত সাধ আছে – প্রাণ হয়ে আছে ভোর।। কী জানি কী হল আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ – দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান। ওরে, চারি দিকে মোর এ কী কারাগার ঘোর – ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা, আঘাতে আঘাত কর্। ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি, এসেছে রবির কর।।
নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতা এর বিষয়বস্তুঃ
“নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসাধারণ রচনা যা তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘গীতাঞ্জলি’র অন্তর্ভুক্ত কবিতার মধ্যে অবস্থিত। এই কবিতাটির বিষয়বস্তু হলো নির্ঝরের একটি স্বপ্নভঙ্গ বা পরিবর্তনশীল স্বপ্ন। কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি মাধ্যমে ব্যক্ত করেন স্বপ্নের অস্থায়ীত্ব ও চিন্তার ভেতর অপরিবর্তনশীলতা। তাঁর দ্বারা বর্ণিত নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গে সৃষ্ট বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য ও অন্যান্য চিত্র মাধ্যমে তাঁর ভাবনা প্রকাশ করা হয়। এই কবিতায় নির্ঝর একটি নিজস্ব প্রাকৃতিক প্রদেশ হিসেবে চিত্রিত হলেও কবিতার মাধ্যমে সেই প্রদেশের মধ্যে নিজের মধ্যে পরিবর্তনের মতো বিভিন্ন ক্ষণিকতা ও পরিবর্তন ঘটানো হয়। কবির মাধ্যমে ব্যক্ত হলো মানুষের মধ্যে জীবনের অস্থায়ীত্ব, চিন্তা ও স্বপ্নের সংকট এবং পরিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট প্রকৃতির বিচিত্রতা। কবিতার মাধ্যমে প্রদর্শিত হলো স্বপ্নের ক্ষণিকতা এবং মানুষের স্বপ্নের অপরিবর্তনশীলতা।
আরো পড়ুন> অনুভূতি সম্পর্কিত উক্তি
শেষ কথা
“নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” কবিতা হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি অসাধারণ কবিতা, যা তাঁর সৌন্দর্যপূর্ণ ভাষা এবং বিচিত্র বিষয়বস্তুতে পরিপূর্ণ। এই কবিতার মাধ্যমে তিনি মানুষের মধ্যে চিন্তার অপরিবর্তনশীলতা, স্বপ্নের ক্ষণিকতা, প্রকৃতির নিখুঁত সৌন্দর্য এবং ব্যক্তির নিজস্ব সৃষ্টিশক্তির মধ্যে সম্পর্কস্থাপন করেন। এই কবিতা মাধ্যমে তিনি নির্ঝরের মধ্যে দৃশ্যগুলি বর্ণনা করেন, সৃষ্টিশক্তির সাথে জড়িয়ে থাকা ব্যক্তির অবস্থান উপস্থাপন করেন এবং স্বপ্নের ভঙ্গ ব্যক্ত করেন। এই কবিতাটি মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষের নিজস্ব বিশ্বাস ও মহকাশের মধ্যে যে যন্ত্রণা বজায় রাখা যায় না তার মধ্যে প্রকাশ করেন। এই কবিতার মূলভাব হলো মানুষের জীবনের অস্থায়ীত্ব, স্বপ্নের অস্থায়ীত্ব, চিন্তার অপরিবর্তনশীলতা এবং প্রকৃতির বিচিত্রতা নির্ভুল শিল্পে প্রকাশিত হওয়া। এই কবিতার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানবজীবনের মানের উপর গভীরভাবে চিন্তন করেন এবং সমস্ত জীবনের নানা সৌন্দর্যের পেছনে স্থিত সত্যকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।